বিশেষ প্রতিবেদক
মাত্র ছয় মাস আগে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ছেলের প্রাণ হারানোর পর ওই বাসাতেই প্রায় একইভাবে একই কক্ষে একই সময়ে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু মারা যাওয়ার ঘটনাকে অনেকেই ‘পরিকল্পিত হত্যাকান্ড’ বলে সন্দেহ করছেন।
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার অপরাধ বিভাগের প্রধান এই সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টারের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে করে তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই লাশের ময়না তদন্তও দাবি করেছেন।
পরিবারের একজন সদস্যের কথিত পরকিয়া সম্পর্ক এবং মাদকাসক্তির যোগসূত্রও খুঁজে দেখার কথাও বলছেন ঘনিস্টদের কেউ কেউ। বাসায় কারা কারা আসতো সেটা সনাক্ত করার জন্য সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
ঘটনার বিষয়ে বাড্ডা থানার ওসি মো. পারভেজ ইসলাম জানান,ঘটনাস্থল তিনি পরিদর্শন করেছেন। আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন জানিয়েছেন যে রাতে স্বামী-স্ত্রীর তুমুল ঝগড়ার শব্দ তারা পেয়েছেন। এরপরই আগুনের ঘটনা ঘটেছে। আগুনের উৎপত্তি কোথা থেকে,সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। গত ২ জানুয়ারি ওই ফ্ল্যাটে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি তদন্ত রিপোর্ট ফায়ার সার্ভিস পুলিশকে দেয়নি বলেও জানা গেছে।
ওই বাড়ির কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন, অগ্নিকান্ডের আগে নান্নু দম্পতির মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে চিৎকার করে বাকবিতন্ডা হয়। এর কিছু সময় পরে বিস্ফোরণ ঘটে।
যদিও মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর বড় ভাই বাবলু হোসেন বলেন, তাদের এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। আমরা মনে করছি, দুর্ঘটনায় আমাদের ভাই মারা গেছে।
যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. সাইফুল আলম বলেন, এই ভবনের হয়তো কোনো ত্রুটি বিচ্চুতি রয়েছে। ওখানে যারা বসবাস করছে, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে হলেও ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার।
নান্নুর মৃত্যুর ঘটনাটি পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) সভাপতি আবুল খায়েরও। তিনি বলেন,ওই বাসার লাইনে সমস্যা রয়েছে। একই বাসায় একই রুমে একই ধরনের ঘটনায় পরপর ছেলে মারা গেল, বাবাও মারা গেল। আমি এটিকে দুর্ঘটনা বলবো না,এটি একটি হত্যাকাণ্ড এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলবো। প্রথম দুর্ঘটনার পরও এই ভবন মালিক, ভূমি মালিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি যে কি কারণে ঘটনাটি ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসও ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। তারাও কোনো তদন্ত রিপোর্ট দেয়নি। ভবন মালিক হোক আর যাদের দোষেই হোক, তাদের ভুল, ত্রুটি ও অবহেলার কারণেই নান্নু ও তার ছেলেকে জীবন দিতে হয়েছে। এজন্য এটি একটি হত্যাকাণ্ড বলবো। কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আহবান জানাই।
ক্র্যাবের একজন উপদেষ্টা ইতিমধ্যেই ক্র্যাবের সাধারন সম্পাদক আসাদুজ্জামান বিকুকে জরুরী ভিত্তিতে ইসির মিটিং ডেকে আইজিপিকে চিঠি দিয়ে তদন্তের অনুরোধ জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে ক্র্যাবের নিজস্ব তদন্ত কমিটি গঠন করে অনুসন্ধান করে প্রকৃত ঘটনা খু্ঁজে বের করা দরকার বলে তিনিও মনে করছেন।
ক্র্যাব মেম্বারস নামে একটি ফেসবুক মেসেঞ্জার সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এছাড়া প্রথম থেকেই ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলার চেস্টা করা হলেও অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলাতে পারছেন না নান্নুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা।
যুগান্তর পত্রিকার ইনভেস্টিগেশন সেলের সম্পাদক মিজান মালিক তাঁর ফেসবুক ওয়ালে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে একটি পোস্টও দিয়েছেন। মুহূর্তেই সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলে।
নান্নু ও তার ছেলের মৃত্যুর ঘটনা শুধুমাত্র গ্যাস বা এসি বিস্ফোরণের ঘটনা? রান্না ঘর থেকে আগুন লাগলে সেখানে কী কোনো চিহ্ন থাকবে না? গ্যাস লাইনে সমস্যা হলে অন্য কোনো ফ্ল্যাটে কেনো একদিনও গ্যাস লিক হয়নি? নান্নুর ছেলে যে কক্ষে যেভাবে অগ্নদগ্ধ হয়েছে,একই কায়দায় নান্নুরও কেনো মৃত্যু হবে? নান্নুর ছেলে যে রাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় সেই রাতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যে শব্দও পেয়েছে একই ধরনের শব্দ এবারও কেনো? আগুনের খবর পেয়ে ভবনের বাসিন্দারা সবাই ভয়ে তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসে। যদি আগুন ওই ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটে চলে যায় সেই ভয়ে। কিন্তু আর কোনো ফ্ল্যাটেই আগুন না গিয়ে একটি কক্ষ আর সেই বারান্দায় কেনো স্থির হয়ে কয়েক মিনিট পর নিভে যায়?
দুবারই ফায়ার সার্ভিসের লোক এসেও তাদের আগুন নেভাতে হয়নি। তারা শুধু অগ্নিদগ্ধ দুজনকে ধরা ধরি করে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে। তাদের অভিজ্ঞতা কী বলে?
নান্নু এমনিতে খুব অসুস্থ। তার সুগার লেভেল অনেক উচ্চ থাকে। এ কারনে শারীরিক ভাবে খুব দুর্বল। রাতের কোনো একটা সময় কিসের শব্দ পেয়েছিল ভবনের বাসিন্দারা?
ওই রাতে নান্নু ছাড়া আর কে ছিলেন বাসায়? তাদের ভূমিকা কী ছিল? তারা কি আগুন নেভাতে চেষ্টা করেছেন? যদি করে থাকেন,তাহলে তাদের কেউ কি সামান্য হলেও আহত হয়েছেন?
চুলার গ্যাস কি ওই কক্ষ পর্যন্ত যায়? অগ্নিদগ্ধ’র ঘটনা কেনো দুবারই রাত সোয়া ৩ টার পর হয়?
গান পাউডার নামক কোনো কিছু কী ব্যবহার করা হয়েছে?
নান্নুর ছেলের মৃত্যুর দিনই কক্ষটি কী পরিষ্কার করা হয়েছিল? আলামত সংগ্রহ করা হয়েছিল কী? তখন না হয় স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে পুলিশ কক্ষ থেকে কোনো নমুনা বা আলামত সংগ্রহ করেনি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় নান্নুর মৃত্যুর পর তো নানা কথা হচ্ছে। পুলিশ কী বাসাটি এখন সিলগালা করবে?
ঘটনার সঠিক তদন্ত কী হবে? বাড়ির ম্যানেজার সিকিউরিটি গার্ড ও অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে কথা বলবে কী? সঠিক তদন্তে যদি এটা প্রমাণিত হয় এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং নান্নুর কাছের স্বজন জড়িত তার বিরুদ্ধে কি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে বেশিরভাগ সাংবাদিকরা মনে করছেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ছিলেন বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যকরী কমিটির সাবেক নির্বাহী সদস্য।