অল ক্রাইমস টিভি ডেস্ক
রান্নাঘরে মশার কয়েল জ্বালাতে যায় ১১ বছর বয়সী শিশু আরিফ হোসেন। দিয়াশলাই জ্বালাতেই মুহূর্তে পুরো ঘর আগুনে ছেয়ে যায়। আরিফকে বাঁচাতে ছুটে আসেন তার মা, বাবা ও ছোট ভাই। অগ্নিদগ্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায় আরিফের ছোট ভাই জোবায়ের হোসেন (৭)। অগ্নিদগ্ধ আরিফ, তার বাবা মকবুল মিয়া (৪২) ও মা রেখা বেগমকে (৩৫) নেওয়া হয় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান মকবুল মিয়া।
বাবার ও ছোট ভাইয়ের পথ ধরে গতকাল রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আরিফ হোসেন। রেখা বেগম ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর গর্ভের সন্তানটিও মারা গেছেন বলে জানান চিকিৎসকেরা। সব হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত রেখা বেগম এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আজ সোমবার সকালে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার শরীয়তনগর এলাকায় গত মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার দিকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী, পুলিশ এবং আশুগঞ্জ, সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের চারটি দলের প্রায় এক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে ততক্ষণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশু জুবায়েরের মৃত্যু হয়। অন্যদের আশুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাঠানো হয় ঢাকায়। নিহত মকবুল হোসেন উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের সফর মিয়ার ছেলে। তিনি সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছিলেন।
বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস। তবে ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহের মাথায় এসে আশুগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গ্যাস থেকেই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিহত সদস্যদের আত্মীয়স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, বাড়িওয়ালাকে বারবার বলার পরও ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের সংযোগ মেরামত না করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে বাড়িওয়ালার ছেলেরা দাবি করেছেন, লাইনের গ্যাস নয়, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শরীফপুর গ্রামে গেলে মকবুল হোসেনের বৃদ্ধ মা খোরশেদা বেগম ও খালা সোফিয়া বেগমসহ স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। খোরশেদা বেগম বলেন, ‘বাড়িওয়ালার গাফিলতির কারণে আমার ছেলের পরিবার শেষ হয়ে গেছে। নাতি-নাতনি, ছেলেসহ চারজন চলে গেছে। ছেলের বউয়ের অবস্থাও ভালো না। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।’
পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রায় ১৩ বছর আগে নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামের রেখা বেগমের সঙ্গে মকবুলের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর বড় ছেলে আরিফের জন্ম হয়। এরপর জোবায়েরের জন্ম হয়। রেখা বেগম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানেরও মৃত্যু হয়েছে।
মকবুলের ছোট ভাই রমজান মিয়া ও চাচা মমিনুল ইসলাম বলেন, ঘটনার প্রায় আট দিন আগে বাসার গ্যাসের চুলার রাইজার ও সংযোগ দিয়ে গ্যাস লিক হচ্ছে বলে বাড়ির মালিককে জানান মকবুল। পুরো ঘরে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ায় তাঁরা গ্রামের বাড়ি শরীফপুরে চলে আসেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওই ভাড়া বাসায় যান মকবুল। তখনো গ্যাসের চুলায় সমস্যা ছিল। বাড়ির মালিককে বিষয়টি জানানো হলে মালিকের ছেলে মাহফুজ গ্যাসের চুলা মেরামতের চেষ্টা করে। পরে দরজা-জানালা খুলে রেখে ফ্যান ছেড়ে দিলে গ্যাস বের হয়ে যাবে জানায় মাহফুজ। চুলার সমস্যার কারণে রান্নাবান্না বন্ধ রেখে হোটেল থেকে খাবার আনান রেখা বেগম। ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে মকবুল তাঁর ছেলেকে মশার কয়েল জ্বালাতে বলেন। রান্নাঘরে গিয়ে বড় ছেলে আরিফ দিয়াশলাই জ্বালাতেই আগুনের সূত্রপাত হয়।
মোমিনুল ইসলাম আরও বলেন, মকবুলের শরীরের ৬২ শতাংশ ও আরিফের শরীরের ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। রেখার শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে, তাঁর অবস্থাও ভালো নয়। আজ সোমবার সকালে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁরা মামলা করবেন বলে জানান।
ওই ভবনের প্রতিবেশী হোসনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল বিল্ডিং বুঝি এখনই ভেঙে পড়বে। দরজা খুলতেই দেখি আগুন। রেখা ম্যাডাম তখন দরজার সামনেই ছিল। তাঁর মুখের একপাশে আগুন লেগেছিল। আগুন নিয়েই ছোট ছেলেকে উদ্ধার করতে ভেতরে যান তিনি।’
ওই ভবনের মালিক আলাই মোল্লাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তাঁর দুই ছেলে আলম মোল্লা ও মাহফুজ মোল্লা বলেন, গ্যাসের চুলায় কোনো সমস্যা ছিল না। তাঁরা প্রতি ১৫ দিন পর গ্যাসের লাইন পরীক্ষা করেন। ঘরের ভেতর গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।
আশুগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। কিন্তু বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কম। ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে। নিহত মকবুল ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকা তাঁর স্ত্রীও গ্যাসের কথা বলেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছেন। এই গ্যাস সিলিন্ডার নাকি লাইনের গ্যাস, তা নিশ্চিত নন। তবে ওই কক্ষে সিলিন্ডারের কোনো আলামত পাননি।
( সুত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৮,২০২২)