নিজস্ব প্রতিবেদক;
ঢাকা : র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব ভুক্তভোগীকে সহায়তা করা হচ্ছে।
বুধবার (১৫ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় র্যাবের হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ভুক্তভোগী যারা আমাদের কাছে আসছেন তাদের আমরা আইনানুগ পরামর্শ দিচ্ছি। সহায়তা করছি, কীভাবে তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানায় যাবেন বা আমাদের কাছে যদি আসতে চান আমরা সে সহায়তা প্রদান করছি।’
তিনি বলেন, ‘পালিয়ে থাকার সময় আমরা তাকে ফলো করেছি, সব পয়েন্ট যদি আমরা জানতে পারতাম তাহলে তখনই তাকে ধরতে পারতাম। আমরা যখনই জানতে পেরেছি এবং তাকে পিনপয়েন্ট করতে পেরেছি তখনই তাকে আমরা অ্যারেস্ট করেছি।’
ছয় মাস পরই আবার বেরিয়ে আসবে এ ধরনের কথা সাহেদ বলেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার ঠিক জানা নেই। অনেক কথা বলেছেন, যেটা আমরা তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে বলতে চাচ্ছি না। তদন্তের স্বার্থে কথাগুলো না বলাই শ্রেয় মনে করছি।’
এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আজই সাহেদ করিমকে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি।
ঢাকায় বেশ কয়েকজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় সাহেদ আশ্রয় নিতে চেয়েছিল এরকম কোনো কর্মকর্তার পরিচয় পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরকম কোনো তথ্য আমাদের কাছে জানা নেই। আপনার কাছে থাকলে জানালে আমরা দেখব।’
র্যাবের মহাপরিচালক বলেন, ‘কিছুদিন আগে (১২ জুলাই) আমরা এস এস এ হসপিটালে অভিযান পরিচালনা করেছি। এই হাসপাতালের মালিকের বিরুদ্ধে এবং যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যেখানে আমরা তথ্য পাচ্ছি, সেখানেই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে হোক বা বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৎপর আছি।’
তিনি বলেন, ‘মামলার যিনি তদন্ত কর্মকর্তা আমরা তাকে হ্যান্ডওভার করব, পরবর্তী ব্যবস্থা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যিনি তদন্ত করবেন তিনি একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা তার মেধা, দক্ষতার আলোকে এবং আইনের আলোকে উনি তার ব্যবস্থা নেবেন।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে আমরা দেখছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাদের যেটা দরকার, তাদের যে ট্রার্মস অব রেফারেন্স আছে সে অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করছেন।’
সাহেদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে এরকম একটা ছবি তোলার মধ্য দিয়ে র্যাব কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে- জবাবে সংস্থাটির মহাপরিচালক বলেন, ‘এটা আমি দেখিনি, এটা পরে দেখে আমরা বলতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। যেখান থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি যাচাই-বাছাই করে ৬ তারিখের পরে ১২ তারিখও আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু এটা তো একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেখানেই আমরা সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
র্যাবের ডিজি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, তাকে গ্রেফতারের পর আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তারপর ঢাকায় এসেছি। ঢাকায়ও তাকে নিয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। আমরা উল্লেখ করেছি, জাল টাকা উদ্ধার করেছি। আমরা যে তথ্য পাই এই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করি।’
তিনি বলেন, ‘যদি আমরা বিব্রতবোধ করতাম, তাহলে তো তাকে অ্যারেস্ট করে আনতাম না। বিব্রতবোধ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমাদের কাছে মামলার তদন্ত গ্রহণের জন্য যে প্রক্রিয়া আছে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কার্যক্রম গ্রহণ করছি।’
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছিল রিজেন্ট। বিনিময়ে তারা জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ৪ হাজার নিতেন। আর বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করলে এক হাজার টাকা বেশি নেয়া হতো। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২০০টির মতো নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতালটি। পরীক্ষা না করেই বাকি ৬ হাজারের মতো নমুনার রিপোর্টই মনগড়াভাবে তৈরি করে দেয় সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল।
করোনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবেও অনুমোদন পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট। এতে করোনা রোগীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেয়ার কথা ছিল না। তবে র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে, রিজেন্টে রোগী প্রতি দেড়লাখ, দুইলাখ ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছিল। পাশাপাশি ‘রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে’ এই বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বিল জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এই অর্থ প্রক্রিয়াধীন থাকলেও শেষ পর্যন্ত পায়নি হাসপাতালটি।
এছাড়া হাসপাতালটিতে করোনা টেস্টের অননুমোদিত কিটও পায় র্যাব। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার যে কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি, সেটি দিয়েও টেস্ট করে রিজেন্ট। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কোনো টাকা নেয়ার কথা না। তবে টেস্টে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে নিত তারা। যাদের ‘করোনা পজিটিভ’ রিপোর্ট দেয়া হতো, তাদের কাছ থেকে ফের পরীক্ষার জন্য আরও এক হাজার টাকা নেয়া হতো।
অভিযোগ থাকায় গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরার শাখায় অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। সেখানেই সাহেদের পাপ সাম্রাজ্যের প্রথম দ্বার উন্মুক্ত হয়। এরপর থেকেই পলাতক সাহেদ। সাহেদকে পলাতক দেখিয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। সিলগালা করা হয় উত্তরার রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়সহ মিরপুরের শাখাটিও। ফ্রিজ করে রাখা হয় সাহেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব। রিমান্ডে নেয়া হয় তার অপকর্মের সহযোগীদের।
র্যাব ডিজির ভাষ্যমতে, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একেকদিন একেক জায়গায় আত্মগোপনে ছিল। ঢাকা, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুকৌশলে আত্মগোপনে ছিল সে। দেবহাটার কোমরপুর সীমান্তে লবঙ্গবাতি খাল দিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করলে সে ধরা পড়ে।
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গ্রেফতার এড়াতে গত কয়েকদিন ধরেই সাহেদ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ একদিন এ জায়গায় তো পরেরদিন অন্য জায়গায়। র্যাব তাকে ফলো করে। গ্রেফতার বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক জানান, ‘সে ঢাকা ছেড়েছে আবার ঢাকায় ফিরেছে, আবার বেরিয়েছে। এসবের মধ্যেই ছিল। এই পুরো সময়টাতে সে কখনও ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে চলাচল করেছিল। অবশেষে নৌকা দিয়ে পার হওয়ার সময় আমরা তাকে ধরতে সক্ষম হয়েছি’।
সাহেদের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলাম জানান, ফজরের নামাজের জন্য তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই তাদের কানে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। শুরু হয় হইচই। ঘটনা কী দেখার জন্য দৌড়ে যান সবাই। গিয়ে যা দেখলেন, সারা দেশের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিমকে ধরে ফেলেছে র্যাব।