
হাবিবুল্লাহ মিজান, সম্পাদক, অল ক্রাইমস টিভি
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার অপরাধ বিভাগের প্রধান প্রতিবেদক মোয়াজ্জেম হোসেন নাননু তাঁর একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পরে তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদ দান করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।
অগ্নিদগ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুর প্রায় দুই সপ্তাহ পরে আজ সোমবার তাঁর নিজের স্ত্রী-শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করার পর অনেকের কাছে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সম্পত্তি দান করার সিদ্বান্তই কি তাঁর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল?
নাননুর একাধিক ঘনিস্ট সূত্র থেকে জানা গেছে,তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে পিয়াসের অকাল মৃত্যুর পরে তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন তিনি। এমনকি গভীর রাতে তাহজুদের নামাজও পড়তেন। মাঝে মাঝে নামাজ শেষে মোনাজাতে কাটিয়ে দিতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। এক পর্যায়ে সিদ্বান্ত নেন তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদ মাদ্রাসা ও মসজিদের নামে দান করে দিবেন। নাননু এই সিদ্বান্তের কথা শুধু তাঁর পরিবারকেই না,তার ঘনিস্ট একাধিক সহকর্মীদেরকেও জানিয়েছিলেন। সম্পত্তি দান করা নিয়ে তাঁর নিজের পরিবারের এক সদস্যের সাথে ব্যাপক বিরোধ তৈরি হতে থাকে দিন দিন।
এখন অনেকে ধারনা করছেন, তাঁর কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা থেকে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে কি না।
এছাড়া মাদকাসক্ত ও পরকিয়া প্রেমে মত্ত তাঁর পরিবারের এক নারী সদস্য তাঁর কথিত প্রেমিকের সাহায্য নিয়ে এই খুনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন বলে অনেকের সন্দেহ।
প্রভাবশালী এই প্রেমিকের কুবুদ্বিতেই নান্নুর লাশ ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সহকর্মীদের আপত্তির মুখেও।
মাত্র ছ’ মাসের ব্যবধানে একই বাসায় একইভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে একমাত্র ছেলে পিয়াসের মতোই নাননুর মৃত্যুতে স্ত্রী ও শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে আজ একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাংবাদিক নান্নুর স্ত্রী শাহিনা হোসেন পল্লবী(৪৫) এবং শাশুড়ি শান্তা পারভেজের বিরুদ্ধে বড় ভাই মোঃ নজরুল ইসলাম খোকন বাদী হয়ে সোমবার(২৯ জুন) দুপুরে রাজধানীর বাড্ডা থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে বাড্ডা থানার ওসি মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, সাংবাদিক নান্নুর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে এর আগে গঠন করা গুলশান বিভাগ পুলিশের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, সিআইডি ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ আলাদা আলাদা তদন্ত করছে। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি তদন্ত কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে নান্নুর মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।
ওসি পারভেজ বলেন, আগুনে পুড়ে নাননুর মৃত্যুর পর স্ত্রী পল্লবী থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিলেন। তবে আজ সাংবাদিক নাননুর আগুনের পুড়ে যাওয়া ও মৃত্যুকে হত্যা বলে দাবি করে বড় ভাই নজরুল ইসলাম খোকন মামলাটি দায়ের করলেন। আমরা এ মামলাটি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
মামলার এজাহারে বাদী নজরুল ইসলাম খোকন উল্লেখ করেন, আমার ছোট ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন নাননু তার স্ত্রী শাহিনা হোসেন পল্লবীর সাথে আফতাবনগরের জহিরুল ইসলাম সিটির ৩ নম্বর সড়কের বি ব্লকের ৪৪/৪৬ নম্বর বাসার দশম তলায় বসবাস করতো। গত ১১ জুন রাত সাড়ে ৩টার সময় আমার ছোটভাই মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু রহস্যজনকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন সকাল ৮ টায় মারা যায়।

এজহারে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঘটনার সময় আমি নড়াইলের কলোরায় নিজ গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। আমি আমার মেজো ভগ্নিপতি আনসার হোসেনের কাছ থেকে নাননুর অগ্নিদগ্ধের খবর পাই। এও জানতে পারি নাননুর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনাটি রহস্যজনক। ঘটনা সময় স্ত্রী ছাড়াও নান্নুর শাশুড়ি শান্তা পারভেজও ওই বাসায় অবস্থান করছিলেন। আমরা আরো জানতে পারি নাননু গত ১১ জুন রাত ১ টার দিকে বাসায় ফেরে। বাসায় ফেরার পর স্ত্রী পল্লবীর সাথে ঝগড়া হয়।এর কিছুক্ষণ পরেই বাসায় আগুন লাগে। নাননুরদগ্ধ হয়। নিজে পাইপ এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। তার স্ত্রী ও শাশুড়ি আগুন নেভানোর চেষ্টা করে নাই এবং নাননু নিজেই ১০ তলা থেকে হেঁটে নিচে নামে। সেখানে আশপাশের ফ্লাট মালিকরা নাননুকে হাসপাতালে। তার স্ত্রী পল্লবী অনেক পরে হাসপাতালে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন পর নাননু মৃত্যুবরণ করে। আমার মেজো ভাই ইকবাল হোসেন বাবলু ও ভাগ্নে সাজ্জাদ হোসেন টিপু একটি ভাড়া গাড়িতে ঢাকায় আসে তারা হাসপাতালে যেতে চাইলে পল্লবী ও তার অফিসের জনৈক সিইও তাদেরকে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করেন পরে তারা হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় যান। নাননু মারা যাওয়ার পর আমাদেরকে না জানিয়ে তার স্ত্রী ও সেখানে উপস্থিত পল্লবী যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো সেই প্রতিষ্ঠান সিইও পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি তার ব্যবহৃত একটি কালো রংয়ের পাজেরো গাড়িতে করে স্ত্রী পল্লবীর গ্রামের বাড়িতে যায়। ওই সিইও’র সহযোগিতায় নাননুর বিনা ময়নাতদন্তের লাশ পল্লবী তার বাড়ি যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার ভাঙ্গুরা গ্রামে দাফন করে। আমার মেজো ভাই ইকবাল হোসেন বাবলুসহ আত্মীয়-স্বজনরা লাশ দেখতে চাইলে তাদেরকে দেখতে দেওয়া হয়নি। আমি লোক মারফত আরো জানতে পারি, নাননু হাসপাতালে থাকার সময় তার স্ত্রী পল্লবী মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ভোর চারটার সময় স্যুপ খাওয়ায় নাননুকে। আর সেই স্যুপ পল্লবীর অফিসের জনৈক সিইও সাহেবের বাসা থেকে রান্না করে আনা বলে জানতে পেরেছি।
উল্লেখ্য, আফতাবনগরের জহিরুল ইসলাম সিটির ৩ নম্বর সড়কের বি ব্লকের ৪৪/৪৬ নম্বর বাসার দশম তলায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন সাংবাদিক নান্নু। গত শুক্রবার(১২ জুন) ভোর পৌনে ৪টার দিকে সেখানে রহস্যজনক আগুনে তিনি গুরুতর দগ্ধ হন। সাংবাদিক নান্নুকে গুরুতর অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। শনিবার (১৩ জুন) সকাল ৮টা ২০ মিনিটে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় তার স্ত্রী শাহীনা হোসেন পল্লবী বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি অপমৃত্যু’র মামলা দায়ের করেন।
এর আগে মাত্র ছয় মাস আগে গত ২ জানুয়ারি ওই একই বাসায় বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তাদের একমাত্র সন্তান মিউজিক ডাইরেক্টর স্বপ্নীল আহমেদ পিয়াস (২৪) প্রাণ হারান। সে সময় ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এ সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু।