লঞ্চডুবি নিয়ে মন্ত্রীর দাবি প্রমাণ করবে কে?


গওহার নঈম ওয়ারা

করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে ২৭ জনের বেশি যাত্রী থাকার কথা নয়। অথচ ঘটনার দিন ২৯ জুলাই পাওয়া যায় ৩২ জনের লাশ। ৩০ জুলাই পাওয়া গেছে আরও ২ জনের লাশ। পানির তোড়ে কেউ ভাটিতে ভেসে গেলে, তা কোনো দিন জানা যাবে না।

তদন্ত শুরু হয়েছে মাত্র। কিন্তু নৌমন্ত্রী যে তার আগেই বলে দিলেন, এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা! এখন এই দাবি তদন্ত কমিটির সার্ভেয়ার, প্রকৌশলী, ফায়ার ফাইটাররা কীভাবে প্রমাণ করবেন? তদন্তকারীরা কি মন্ত্রীর কথার বাইরে অন্য কিছু প্রমাণ করতে চাইবেন, নাকি তা পারবেন? নৌমন্ত্রী কীভাবেই-বা জানলেন এটা পরিকল্পিত ঘটনা! আগের নৌমন্ত্রী বলতেন, কেউ ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। নতুন মন্ত্রী বলছেন, পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে কী পার্থক্য তা আল্লা মালুম।

লঞ্চ ছাড়ার আগে ঘাট সুপারভাইজার একটা ‘ভয়েজ ডিক্লারেশন’ বা যাত্রা সনদ দেন। লিখিত এই কাগজে যাত্রীসংখ্যা, ধারণক্ষমতা, চালকের নাম ইত্যাদি লেখা থাকে। এখন পর্যন্ত সেই কাগজের হদিস পাওয়া যায়নি। তবে তদন্ত শুরু হতে হতে কাগজ তৈরি হয়ে যাবে হয়তো। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার অভিযানে আসার সময় বুড়িগঙ্গা-১ সেতুতে আটকে যায় উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’। এ সময় সেতু এবং উদ্ধারকারী জাহাজের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে আর উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে পারেনি প্রত্যয়।

একবার শুধু দেখব
ঢাকার কসাইটুলির কাছে এক মাদ্রাসায় পড়ত শিফাত। ৯ বছরের শিফাত বুঝে গিয়েছিল, তার আর লেখাপড়ায় ফেরা হবে না, আলোঝলমল ঢাকার জীবনে তো নয়ই। তাই যখন তার বাবা তাকে গ্রামের বাড়ি মিরকাদিমে রেখে এক বেলার জন্য ঢাকায় আসতে চায়, তখন সে তাদের সঙ্গে আসার জন্য জেদ করে। হয়তো ভেবেছিল, যদি তার বন্ধুদের সঙ্গে শেষ দেখা হয়ে যায়! কসাইটুলির মসজিদ, মহল্লার পঞ্চায়েত ঘর খুব মিস করছিল সে। বলেছিল ‘একবার শুধু চামু (দেখব)’।

মহামারি করোনা তাদের জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। জজকোর্ট বন্ধ, তাই মুহুরি বাবা কসাইটুলির ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন দেশের বাড়ি মিরকাদিমে। নাছোড়বান্দা বাড়িওয়ালা জুন মাস পর্যন্ত ভাড়া শোধ না করায় মালপত্র নিতে দেয়নি। সেই টাকা জোগাড় করে মালপত্র নিয়ে দেশের বাড়িতে একেবারে ফিরে যাওয়ার জন্য বাবার আসার কথা ছিল শুধু মাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত শিফাতকে নিতে হয় তাঁদের। এখন সবাই লাশ। ‘মর্নিং বার্ড’ নামের লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ঢাকার সদরঘাটে আসছিল। সোমবার (২৯ জুন) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সদরঘাটে যাত্রী নামানোর ঠিক আগ মুহূর্তে ময়ূর-২ নামের একটি লঞ্চের ধাক্কায় শ্যামবাজারের কাছে মাঝনদীতে ‘অর্ধশতাধিক’ (ঠিক সংখ্যা কেউ জানে না) যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি।

কেমন করে ঘটল
বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি নৌযান রয়েছে, এগুলোর মধ্যে ফিটনেস সার্টিফিকেট রয়েছে মাত্র ৯ হাজারের। এসব ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার দায়িত্ব সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের। কিন্তু এই কাজের জন্য তাদের জরিপকারী রয়েছেন মাত্র চার-পাঁচজন। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের পরিদর্শন ছাড়াই শুধু মালিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালকের মতে, ‘‘ব্যাগার’ (ব্যাক গিয়ার) দিয়ে মূল চ্যানেলে আসার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, চালকদের অদক্ষতা বা অসাবধানতাই মূল কারণ। এখানে চ্যানেলটা অনেক বড়, পানিও বেড়েছে। কিন্তু তারপরও ময়ূর-২ ব্যাগার দিয়ে মর্নিং বার্ডকে ডুবিয়ে দিয়েছে।’

লঞ্চ পেছনে নেওয়ার সময় নিয়ম হচ্ছে, একজন মাস্টার পেছনে চলে আসবেন এবং লঞ্চের পেছনে যাওয়ার ভেপু (হুইসেল) হবে অন্য রকম, যাতে অন্যরা বুঝতে পারে।

সদরঘাটের আশপাশে চলতি বছরে ঘটা ১৩ নম্বর দুর্ঘটনা ছিল এটা। ১২টির ১টিও আমলে নেওয়া হয়নি। মৃতদেহের সংখ্যা দিয়ে দুর্ঘটনার ঘনত্ব মাপার কালচারের কাছে এসবই ছিল অতি সামান্য ঘটনা ‘সামান্য ক্ষতি’। ১২টির মধ্যে ছিল লঞ্চে-লঞ্চে সংঘর্ষ ৬টি এবং লঞ্চের সঙ্গে ছোট নৌকার সংঘর্ষ ৬টি। এই ছোট ছোট দুর্ঘটনা কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি বলেই আজ এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ধরনের অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে তাঁরা বলছেন, চাইলেই এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। ২০১৯ সালে সারা দেশে লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে ১১৬টি। এগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাক্কার কারণে ডুবেছে ৪৪টি জলযান। ছোট দুর্ঘটনা বা দু-একজন মারা গেলে আমলে নেওয়া হয় না এমন অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান। তাঁর কথা হচ্ছে, ‘আমরা সব ধরনের দুর্ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এখন কেউ যদি আইন না মানেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতনও হতে হবে। আমরা সব সময় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি—দুর্ঘটনাকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে।’

সব চেয়ারম্যানই এমন বলেন, তিনি কেন ভিন্ন কথা বলবেন
সংবাদকর্মীরা ঢাকা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তদন্ত কমিটি হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? চেনাশোনা উত্তর তিনিও দিয়েছেন। ‘অবশ্যই কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেনি।’ আত্মতুষ্টির মিথ্যা ঢেকুর আমাদের জননিরাপত্তার আরেক বাধা। বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ ডোবেনি বলে শর্ষের তেল নাকে দিয়ে বসে থাকলে এ রকম দুর্ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। কয়টা বয়া, লাইফ জ্যাকেট থাকে লঞ্চগুলোতে? কে চালায় এই নৌযানগুলো, সে সব কি আমরা দেখব না? বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ দুই বছরে ডোবেনি বলে? লাইফ জ্যাকেট যে কতটা প্রয়োজন, সেটা অবশ্য আমাদের সংবাদমাধ্যমের কর্তাদেরও সম্ভবত জানা নেই। লাখ টাকার ক্যামেরা ইত্যাদি দিয়ে তরুণ সাংবাদিকদের ‘সাহসী’ কাজের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু একটা দুশো টাকার লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয় না। তাহলে লঞ্চমালিকদের কাছ থেকে সেটা আশা করি কীভাবে?

তদন্ত কমিটিতে কারা আছেন
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাতজনের কমিটিতে একজনও বেসরকারি নাগরিক নেই। যাঁরা নিয়মিত লঞ্চে যাতায়াত করেন বা নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা-মামলা করেন, তাঁদের মধ্যে এমন একজন মানুষও কি নেই, যিনি ন্যায্য কথা বলতে পারতেন? এ রকম কাউকেই তদন্ত কমিটিতে রাখা গেল না! এই তালিকায় শিক্ষক যিনি থাকবেন, তিনি বড়জোর ডিজাইন নিয়ে মতামত দেবেন। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার (৩০ জুন) এবং বুধবার (০১ জুলাই) বেলা তিনটার দিকে সদরঘাটে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে। সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুকদের দলে দলে এসে সাক্ষ্য দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। উচিত ছিল প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষদের বাড়ি গিয়ে সাক্ষ্য নেওয়ার। এখন কাদের সাক্ষ্যে কাদের বিচার হবে, কে জানে।

তারপরেও ভরসা রাখতে হয়
নৌ-পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘লঞ্চমালিক, চালক ও স্টাফদের সঙ্গে আমরা প্রায়ই বৈঠক করি। তাঁদের নিয়ম মেনে লঞ্চ চালাতে বলা হয়। কিন্তু অনেকেই কেয়ার করে না। সামনে নিয়ম না মেনে লঞ্চ চালালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অদক্ষ চালক ও স্টাফদের কোনো লঞ্চেই উঠতে দেওয়া হবে না। যারা আইন মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তাঁর কথাটা পোশাকি পোশাকি প্রেসনোট টাইপ শোনালেও বিশ্বাস করতে মন চায়।